বুধবার, ডিসেম্বর ১২, ২০১২

লাল লাল রক্তে ভেজা বিশ্বজিতের দেহটি আজ বাংলার দশদিকে জেগে ওঠা সাম্যবাদের গাছ।


বিশ্বজি দাস মারা গিয়ে প্রমাণ করেছে আমরা যারা জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে আছি তাদের মনুষ্যত্বে টান পড়েছে। এই মনুষ্যত্ব কী ফিরে আসবে বিশ্বজিতের প্রাণের বিনিময়ে? সে তো একা মরেনি; গত বিয়াল্লিশ বছরে এই দেশের কত কোটি মানুষ, কত লক্ষ স্তন্যপায়ী, কত হাজার পাখি, কত শত উভচর-সরীসৃপ-মাছ এই দেশ হতে হারিয়ে গেল? তারা কী তবে সাথে করে নিয়ে গেছে আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের চেতনা? কত শত ঝড়, জলোচ্ছাস এসে কেড়ে নিয়ে গেলো কত লক্ষ প্রাণ! বিশ্বজিতের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড় আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেলো জলোচ্ছাসে-ঝড়ে ভীত হওয়ার কিছু নেই, আমরা যদি না লড়ি তবে হারিয়ে যাবে আমাদের মনুষ্যত্ববোধ।

বিশ্বজি ছিলো এক সাদামাটা জীবনের সহজ মানুষ; তার সামরিক বাহিনী কিংবা নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী ছিলো না। সে যেই গলিতে মারা গিয়েছিলো সেখানেই জন্ম নিয়েছিলো। ছোট ছোট স্বপ্ন আর একগলা যন্ত্রণার মাঝেই সে দিনযাপন করতো। প্রতিদিনের অভাব আর একচিলতে রোদ দেখে তার রাতগুলো পার হতো। সেই এক বিশ্বজিত যাকে নিয়ে তার হাড়-হাভাতে পিতামাতা বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেছিলো।

কিন্তু বাস্তব ছিলো নির্মম!!!!  

হাতে সেলাইকলের চাকা আর এক বুক স্বপ্ন নিয়ে তুমি
বের হয়েছিলে তুমি সকালটায়, সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত
ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের এই পোড়া দেশ,
তাড়া ছিলো না তোমার অফিস যাওয়ার,
কেউ তোমাকে দিব্বি দেয়নি গোপনে দেখা করবার,
আর সেদিন কোথাও কোনো সার্কাস বা বাঁদর নাচও ছিলো না,
বরং ছিলো দেশজুড়ে তোমার পছন্দের ক্রিকেটের আমেজ;

এক ঝাঁক দেশপ্রেম বুকে নিয়ে বাংলার রাজপথে হাঁটতে হাঁটতে
যখন তুমি ভাবছিলে মায়ের ছোটবেলার রুগ্ন ঘরখানার কথা;_
তখনই দেখলে অকস্মা তোমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে
রামদা-রড-আর-কিরিচের ঝলসানি-মুখর ধূসর আকাশ;

কোথায় পালাবে তুমি, এতো এতো মানুষ?
গোটা পথ জুড়ে শুধু চলমান নগ্ন হাত পা,
একটি জীবন যেন গোলাপ ফুলের থেকেও সুন্দর
সেই জীবনের পোড়া ঘরে কাত হয়ে শুয়ে আছে যে বৃদ্ধ বাবা
তার কাছে চাওনি তুমি ব্যর্থতার শেষ কৈফিয়ত?
বরং শুনলে তুমি ধর-ধর, মার-মার চিকার
যেন এক ক্ষুধার্ত বাজপাখি পেয়েছে খাদ্যরূপে
বহুদিন পরে তার সাধের খরগোশটিকে।

কারা যেন করল আঘাত তোমার সমস্ত শরীরে?

তুমি কী চিনতে তাদের, চেনে কী ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল?
তারাই একদা লুট করে নিয়েছিলো বাংলার সমস্ত সম্পদ,
তারাই দেশে দেশে নাম-ভেদে আগ্রাসি লুটেরা
মোগল, আফগান, তুর্কি, ব্রিটিশ, পাকিস্তানী;

আজ তারাই মুছে ফেলেছে মানুষের আগাগোড়া সব পরিচয়
তারা এখন চেনে না ভাই-বোন-বাবা-মা; পড়শী-প্রেমিক;
তারা শুধু চেনে ব্যবসা-মুনাফা-টাকা, লুটপাট-জোর;
তাদের আধুনিক নাম পুঁজির দালাল/কোটিপতি/মুনাফাখোর।

কী করে বাঁচবে তুমি এই হত্যার ঝলসানিতে?
লোভের যে সমাজে জন্মেছো তুমি সেইখানে লাশের স্তুপে
জীবন্মৃত আজ ষোলো কোটি বঙ্গ-সন্তান;
পুঁজির গান ও ঘ্রাণে তারা সবে আজ অবশ-মাতাল
মৃদু আলোয় কেউ আর কোনোভাবেই দেখতে চাইছে না,
এর থেকেও তীব্রতর শীত শেষে আসবেই বসন্ত।

তুমিই আক্রান্ত আজ জান্তব নরপিশাচ আদিম শক্তির;

মানুষেরা আর কী লড়বেনা কোনোদিনই এই বাংলায়?

ুমি কোনো দিনই জানবে না যেকজন মহান মানুষ
ঠুকছে শেষ আঘাত ব্যক্তিগত সম্পদের চেক-দলিলে
সেই সব সম্পদের চোরাবালি বিলুপ্ত করেই তারা
প্রতিশোধ নেবে তোমার রক্তমাখা নিথর দেহের।  

হাজারো সত্যের মতো আমরা কেউ কেউ জানি
তুমি এই টাকাবোঝাই সভ্যতার একমাত্র বলি নও;
এইভাবে কৃষকেরা, শ্রমিকেরা, দাস ও গৃহিণীরা
হাজার বছর গেলেও খাদ্য হয়ে আসছে মালিক-প্রভুর;

তবুও আশা থাকে, গাছের ফুল থেকে জন্ম নেয় বিদ্রোহের বীজ
কিছু কিছু রক্তবীজ গণ-প্রতিরোধের ডাক দেয়;
তোমার রক্তমাখা দেহ হতে গড়ে উঠছে সমতার যুগ।


বিশ্বজিদাসকে যারা আক্রমণ করেছিলো, তাদের ছিলো অস্ত্র, পুলিশ, মন্ত্রি, আমলাতন্ত্র, টাকা, আইন এবং সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র। রাষ্ট্র এমন এক প্রতিষ্ঠান এবং পুঁজিবাদি সমাজের চাকা এমনই শক্তিশালী যে ওই চাকার নিচে পড়েই শ্রমিক কৃষকের মৃত্যু হয়। রাষ্ট্র সব খানেই জালিয়ে রেখেছে আগুন; রাষ্ট্রের ভেতরে সর্বদাই নরকের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সেই শিখাকে প্রথম যে মহামানবটি দেখেছিলেন তার দিকে বাংলাদেশকে কোনোভাবেই নেয়া যায়নি। তাই তোমাকে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াতে হয়েছিলো, যেমনটি আমরা অনেকেই দৌড়াই। এই দৌড়ে সকলেই মারা যায়। তুমিই শুধু


বাংলার ছেঁড়া রাজপথে দৌড়াতে দৌড়াতে
বাঁচতে চেয়েছিলে

সবাই তখন ছিলো আতংকের শীর্ষমুখে,
কে কার খবর রাখে,
নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে বাংলার দামাল সন্তান তুমি
একেকটি বদ্ধ দ্বারে অবিরত কড়া নেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে
বাঁচতে চেয়েছিলে;

তুমি তখন প্রাণপণে মৃত্যুভয়ে ভীত এক আদিম মানব
শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছ এক টুকরো বাঁচবার দুরাশায়।

মৃত্যু মৃত্যুই জানি, সবচেয়ে আদিম, সবচেয়ে ভারি, 
সেই মৃত্যুই এনে দিলো আমাদের চোখে-মুখে
একটি সহজ সত্য, আমরা আর কেউ বেঁচে নেই।  

তোমার শরীর থেকে গড়িয়ে পড়ছে ঢেউ,
ছড়িয়ে পড়ছে ঢেউ নদী-বন-পাহাড়ে-সমতলে,
রক্তের একেকটি ঢেউ থেকে গান গেয়ে উঠছে
বাংলার শেষ বীর, বিদ্রোহী শ্রমনিবিড় কৃষক সন্তান।

তোমার মৃত্যু যেন আরো আরো জীবনের অমোঘ বিধানঃ

বাঁচলে লড়াতে হবে, বাঁচলে বাঁচাতে হবে মানবজীবন।
সকালের রোদে রাঙা আমাদের লাল লাল রক্তে ভেজা
বিশ্বজিতের দেহটি আজ বাংলার দশদিকে জেগে ওঠা সাম্যবাদের গাছ  


একজন মানুষ মারা যাচ্ছে, তার বিপরীতে লক্ষ মানুষ আশা করছে যন্ত্রণার দিন, নরকের আগুনের দিন শেষ হবে এক দিন। কোনো এক চমকার ভোরে দেখবো গোটা দেশে জনগণ গান গাইছে আর হাওয়ায় দুলছে একটি পাখির পালক যা শান্তির-সাম্যের-স্বধীনতার; একটি সকাল গাইছে সাম্যবাদের গান মানুষের হৃদয়ে।

1 টি মন্তব্য:

Featured Post

বাংলাদেশের পাখির তালিকা, A checklist of the birds of Bangladesh.

Oriental Magpie Robin; National Bird of Bangladesh বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর তালিকাটি অনেক সমৃদ্ধ। এদেশ পাখির দিক দিয়...