১৯৭১ পরবর্তীকালের
বাংলাদেশের রক্তপাতের ইতিহাস পড়তে গেলে আমাদের সকলের নানা অনুভূতি তৈরি হয়। আমি নিজে খুব বেশি অনুভব করি যে, বাঙলার শ্রমিক-কৃষকদের যুদ্ধ, শ্রেণিযুদ্ধ, গেরিলাযুদ্ধ ও সমর বিষয়ে জ্ঞানের অভাব রয়েছে। অথচ শ্রমিক কৃষকদেরই এইসব জ্ঞানের প্রয়োজন বেশি। সত্তরের দশকে সাধারণ সেপাইরা যুদ্ধে নামছে এবং পরাজিত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের পৈশাচিক হোলিখেলায় যখন একটি নবলব্ধ পতাকা হারিয়ে যাবার উপক্রম তখন বিপ্লব এক অজানা রোমাঞ্চকর ও তামাশার বিষয়ে পরিণত হয়ে যায় সেনাবাহিনীর সাধারণ জওয়ানদের কাছে। আর সেনাবাহিনীর অফিসারদের কাছে ক্ষমতামদমত্ত হবার তখন অপার সুযোগ। ঘটতে থাকে অজস্র অনভিজ্ঞ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
"কারণ পরিকল্পনাকারীরা জানত না তারা কী করতে চাইছে। জওয়ানরা একে অপরকে
বলতো চলো বিপ্লব করি, যেন তারা একটি পিকনিকের জন্য প্রস্তাব দিচ্ছে।"১
এইভাবেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জটিল সময়গুলোতে কৃষক সন্তানেরা পিছিয়ে গেছেন। কয়েক বছর পরের বিডিআর বিদ্রোহের সময়ও দেখা যায় একই ঘটনা। আর আনসার বিদ্রোহ দমনে রক্তের গঙ্গায় স্নান করে বসেন কতিপয় নরপিশাচ।
রক্তপাত আগুনের চাকার ঘুর্ণনগতিকে বাড়িয়ে দেয়। সেই চাকা চলতে শুরু করলে সহজে থামে না। বাংলাদেশের ৫০ বছর পূরণ হতে যে কয়েকবছর বাকি আছে তাতে রক্তপাতের আগুন-চাকার গতি বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা যদি পুরোনো চাকার মাইলফলকগুলোর দিকে নজর দেই তাহলে দেখবো ১৯৪০-এর দশকের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় যে পরিমাণ রক্তপাত, ১৯৭১-এ ঘটে তার প্রায় তিন গুণ।
১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে বন্দুকের নল জনগণের বুকের দিকে ঘুরে যায়; সেই ধারা আজও চলছে। তারপর শুরু হলও সেইসব ঘটনা। জাসদের মিছিলে গুলিতে প্রায় ৫০ জন প্রাণ হারালো, মাত্র চার বছরের মুজিব শাসনামলে ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা হাওয়া হয়ে গেলো। এরপর জিয়ার আমলে ৪০০০ সেনাবাহিনীর সদস্য হত্যা; পার্বত্যাঞ্চলে জিয়া-এরশাদ মিলিয়ে প্রায় ৫০০০০ হত্যা। ক্রসফায়ারসহ অন্যান্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ১৯৯১ পরবর্তীকালে অন্তত ৫০০০ হত্যা। ১৯৭১ পরবর্তী তিনটি ঘটনাকে বিদ্রোহ বিবেচনা করলে সেগুলো হলো সিপাহি জনতার বিদ্রোহ, আনসার বিদ্রোহ এবং সর্বশেষ বিডিআর বিদ্রোহ। এসবই পতাকার সাথে জড়িয়ে যাওয়া লাল লাল রক্ত। এছাড়াও নানা আন্দোলনে ফ্যাসিবাদি লিগ-বিএনপি’র মাধ্যমে ঘটেছে অন্তত কয়েকশ হত্যাকাণ্ড। সর্বশেষ ১৮ নভেম্বর, ২০১৩ গাজিপুরে দুজন শ্রমিক মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে।
যুদ্ধ সম্পর্কে বাঙালির পাঠ খুব সামান্য, যদিও অভিজ্ঞতা অসামান্য। নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে সেই ইঙ্গিত আছে। যুদ্ধ সম্পর্কে পড়তে গিয়ে আমরা যেন ভুলে না যাই কার্ল মার্কসকে, কেননাঃ
“History repeats itself, first as a tragedy, then as a
farce and farce will give birth to another tragedy, quantitatively and
qualitatively more severe than the previous tragedy.”
আর কেন মনে রাখব এতো কিছু, কারণ মানুষই ইতিহাসের নির্মাতা। ইতিহাসের গতিকে সঠিক দিকে ঘুরাতে হলে অতীতের দিকে আলো ফেলা জরুরি। দেখা দরকার অতীতের যুদ্ধ, বিদ্রোহ ও বিপ্লবগুলোর প্রকৃতি। কেননা বাংলাদেশ মোটেই ভাল নেই; "ইতিহাস লিখবে যে এত মানুষ মরেছে/ বড়ই করুণ এবং বড়ই দুঃখজনক/... ...এভাবে মানুষ মারা চলবে না।২
তথ্যসূত্রঃ
১. ফরিদ কবির অনূদিত, অ্যান্থনি মাসকারেনহাস-এর "বাংলাদেশ: আ লিগ্যাসি অফ ব্লাড" বন্ধু প্রকাশনী, ঢাকা; মে ১৯৮৭, পৃষ্ঠা- ১৪৩।
২. আমার বন্ধু নিরঞ্জন
/ ভাস্কর চৌধুরী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন