বস্তুবাদী লালন |
লালন (১৭৭২- ১৭
অক্টোবর, ১৮৯০) হিন্দু কী যবন এ-প্রশ্ন অনেক গবেষকের কাছেই দীর্ঘদিনের প্রশ্ন। কিন্তু
সাধারণ জনগণের কাছে লালন অতীতেও মানুষ ছিলেন বর্তমানেও মানুষ আছেন। লালনকে নিয়ে
সমস্যা বাঁধিয়েছেই বিড়াল তপস্বী উচ্চ শিক্ষিত পণ্ডিতেরা আর সাম্প্রদায়িক উচ্চবিত্ত
ও মধ্যবিত্তরা।
সাম্প্রদায়িক
ভেদমুক্ত বস্তুবাদে সমৃদ্ধ লালনের গান বাংলার শ্রমিক - কৃষকের কাছে আজো জনপ্রিয়। লালনকে একজন বস্তুবাদীরূপে বিবেচনা করা কঠিনও
নয়। লালন
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বাইরে গিয়ে সারা জীবন জনগণের বস্তুবাদকে জীবনে অনুশীলন
করেছেন।
জাতিভেদ
বিরোধি ঐতিহ্যটি বাঙলায় এক মহান ধারা হিসেবে চিরদিনই টিকে ছিল। প্রাচীনকালে এ
অঞ্চলে জাতিভেদ বিরোধী ছিলেন বৌদ্ধ, জৈন, বস্তুবাদী, চার্বাক, আজীবিক, আদিম
জনজাতিগণ, লৌকিক তন্ত্রীরা। মধ্যযুগের তাবৎ ভক্তি আন্দোলন ধর্ম, লিঙ্গ, জাতিকে
অগ্রাহ্য করেছে। বিশ শতকের পূর্বেই কর্তাভজা, সাহেবধনী, খুশী বিশ্বাসী, মতুয়া,
সহজিয়া বৈষ্ণব প্রভৃতি লোকায়ত গোষ্ঠী জাতিভেদ বিরোধী আন্দোলন চালিয়েছেন। সেই
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলা বাউল গানে এসেছে,
“নানান
বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ।
সারা
জাহান ভ্রমি দেখি একই মায়ের পুত।”
এসবের
ধারাবাহিকতায় লালন সাম্যবাদি সমাজের কথা, শ্রেণিহীন সমাজের
কথা
তাঁর গানে ফুটিয়ে তুলেছেন। নানা গানে নানা অভিব্যক্তিতে তিনি বলেছেন
শ্রেণিভেদ ও জাতিভেদ বিলুপ্তির কথা। যেমন ‘সব লোকে
কয়
লালন
কি
জাত
সংসারে/ লালন
বলে
জাতের
কি
রূপ
দেখলাম
না এই নজরে’ কিংবা বলেছেন ‘‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/
যে দিন
হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান জাতি গোত্র নাহি রবে’।
এমন আরো
অনেক
উদাহরণ
দেয়া
যায় যেগুলোতে তাঁর দর্শনের অনেক বস্তুবাদি উপাদান ছিলো।
লালনের বস্তুবাদকে প্রাধান্য করে নিজের জীবনে সেসব অনুশীলন করেছিলেন। নিচে এরকম অনুশীলনের আটটি উদ্ধৃতি দেয়া হলো। গানের এসব উক্তি থেকেই আমরা বুঝতে পারবো লালন বস্তুর উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
১. মানুষের বীজে হয় না ঘোড়া
ঘোড়ার বীজে হয় না ভেড়া
যে বীজ সে গাছ জগতজোড়া
দেখরে তুই দুই নয়নে।
২. বস্তু বিনে নামে পেট কই ভরে।
৩. নৌকা ঠিক নাই বিনা পাড়ায়
নিরাকারে মন কি দাঁড়ায়।
৪. শরাতে সরপোষ লেখা যায়
বস্তু মারফত তাইতে ঢাকা রয়
সরপোষ নিই তুলে
কি দেই গো ফেলে
লালন বস্তুর ভিখারি।
৫. ভজ মানুষের চরণ দুটি
নিত্য বস্তু পাবে খাঁটি
ম’লে হবে সকল মাটি
ত্বরায় লও সে ভেদ জেনে।
৬. নূর কী পানি বস্তু জানি লালন ফকির কয়।
৭. বস্তুকেই আত্মা বলা যায়
আত্মা কোনো অলৌকিক কিছু নয়।
৮. ক্ষিতি
জল বাই হুতাসোন জে বস্তু যার শেইখানে মেশাইবে তা।
আকাশে মিশবে
আকাশ জানা যায় এই পঞ্চ বেনা।
বাউল বিশ্লেষক শক্তিনাথ ঝা তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘বস্তুবাদী বাউল’১ - এ দেখিয়েছেন যে বাউল সমাজের কেন্দ্রিয় বিশ্বাসের মর্মবাণী হলো, বর্তমান মানি, অনুমান মানি না। প্রত্যক্ষ মানি, অদেখা মানি না। বর্তমান তাদের কাছে প্রত্যক্ষ সত্য এবং অনুমান অসত্য। বাউল সমাজ ধর্ম ও চিন্তাকে দুভাবে ভাগ করে। প্রথমটি বর্তমানপন্থী এবং পরেরটি অনুমানপন্থী। বর্তমান বলতে অস্তিত্ববান সত্তা, যা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায়; অর্থাৎ যা জীবিত, প্রত্যক্ষ ও বাস্তবিক তাকেই বোঝানো হয়েছে। আর অনুমান বলতে সূক্ষ্ম চিন্তা অথবা কাল্পনিক জিনিস যার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই অর্থাৎ যা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রমাণ হয় না বা প্রত্যক্ষ হয় না তাকে বোঝানো হয়েছে। এবং এই দুই রকমের অর্থেই শব্দ দুটি বাউল গানে ব্যবহৃত হয়েছে। লালন এই বর্তমান বা বাস্তব বস্তুবাদের অনুসারী। তিনি অদেখা ভাবুক দলে২ যাননি, প্রত্যক্ষ দর্শনের তিনি পথিক।
মাও সেতুং
দ্বন্দ্ব সম্পর্কে নামক দার্শনিক প্রবন্ধে লিখেছেন “মানুষের জ্ঞানের ইতিহাসে বিশ্ব
বিকাশের নিয়ম সম্পর্কে চিরকালই দুটি ধারণা চলে এসেছে, আধিবিদ্যক
ধারণা এবং দ্বন্দ্ববাদী ধারণা।” মাও সেতুং-এর এই বাক্যটির
‘চিরকালই’ শব্দটির প্রতি গুরুত্ব
নির্দেশের জন্য জোর প্রদান করার ব্যাপারটিকে খেয়াল করলে বুঝবো যে সবকালেই
কিছু মানুষ বস্তুবাদকে আঁকড়ে জীবন নির্বাহ করতেন। লালনের জীবনকালের সেই সময়ের
প্রেক্ষিতে তাঁকে মুল্যায়ন না করলে যান্ত্রিক মূল্যায়ন হতে পারে। ২০১২ সালের
বস্তুবাদ ও ১৮৬০ সালের বস্তুবাদচর্চার ভিতর ভিন্নতা থাকলেও লালন সেইসব যুক্তিই
দিয়েছেন যা ভারতীয় প্রাচীন বস্তুবাদিরা দিয়ে গেছেন।
মার্কসবাদি না হলে
কেউ
প্রগতিশীল
হতে পারে না। বিপ্লবী হতে পারে
না।
এটা
খুবই
দূর্বল
চিন্তা।
কেউ
বিপ্লবী
কিনা সেটা নির্ধারণ হয় তার সমাজের সাপেক্ষে। এবং তিনি তার সমাজকে
পরবর্তি
উন্নত সমাজে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন কিনা সেই
দৃষ্টিকোণে।
তথ্যসূত্র ও
টীকাঃ
১. এই নিবন্ধটি শক্তিনাথ ঝা’র
মহাগ্রন্থ বস্তুবাদী বাউল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে
দে’জ পাবলিশিং; কলকাতা।
২. লালনের একটি পদে আছে ‘তবে কেন যাই
অদেখা ভাবুক দলে’।
আরো পড়ুনঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন