মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ২৭, ২০২২

আত্মমর্যাদাহীন মধ্যবিত্তের ভাষা সমস্যা

 


বাংলা ভাষায় আমরা ইংরেজি শব্দ অহরহ যুক্ত করি। এছাড়াও বাংলায় অন্য ভাষা যেমন ফারসি ও পর্তুগীজ থেকেও অনেক শব্দ আত্মীকৃত করা হয়েছে। কিন্তু এসবের খুব একটা প্রয়োজন কোনোকালেই ছিল না, এখনো নেই। চীনের বিভিন্ন ভাষায় র‍্যাম, হার্ড ডিস্ক, প্রসেসরসহ কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট সব শব্দেরই নাকি একাধিক চীনা অনুদিত শব্দ আছে। বাংলাতেও সেসব সহজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এজন্য পরিভাষার বিকাশ খুব দ্রুত হওয়া দরকার।

যারা উপনিবেশবাদীদের অত্যাচারের শিকার হয়নি, তারা স্বাধীনভাবেই নিজ ভাষাকে রক্ষা করে থাকে। আমার যেসব জাতি নয়া উপনিবেশবাদের শিকার হচ্ছে না, তারাও নিজ ভাষাকে রক্ষা করতে পারছে। চীন এবং নেপাল হচ্ছে এমন দুটি দেশ যারা নিজেদের ভাষাকে রক্ষা করছে। কিন্তু বাংলাদেশে উপনিবেশিক নিপীড়নের ফলে  আত্মমর্যাদাহীনতার কারণে নিজ ভাষাতে ইংরেজি বা অন্য ভাষার চিহ্নগুলো বাড়ছে। যেমন, নেপালীরা তাঁদের নিজস্ব ভাষাগুলিতেই কথা বলে। তাদের নিজ ভাষাগুলোকে তারা মিশ্র ভাষা বা খিচুড়ি ভাষা করেনি। নেওয়ারী ভাষা, নেপালী ভাষা, ডোটেলি ভাষা ইত্যাদি সবগুলাই সংস্কৃত জাত, কিন্তু ওরা বাংলা অঞ্চলের মতো বাংলা আর ইংরেজি মিশ্রিত করেনি।

আমরা চাইলেই কিছু শব্দ বাংলা চালু করা যেত, পরিভাষাগুলোকে সংস্কার করা যেত, নতুন নতুন পরিভাষা সৃষ্টি করা যেত। যেমন, নেপালে ঝোলা শব্দটা খুব চলে, কেউ ব্যাগ বলে না। এখন আমরা বলি টিফিন ক্যারিয়ার, এটার বাংলা হওয়া দরকার।  এটাকে খাবার ঝোলা বলা যেতে পারে, যদিও টিফিন ক্যারিয়ারে জল থাকে না। জল রাখবার জক বা জগ নামক পাত্র আছে যাহা পানির পট নামে সমধিক পরিচিত।

তবে বাঙালি মধ্যবিত্ত যেহেতু উৎস থেকেই দাসত্বে অভ্যস্ত, তাই তাদের কাছে বাংলাটা ঠিক আসে না। তাই আমরা বলছি পরিভাষার গ্রহণ করার মানসিকতা থাকা চাই সংখ্যাগরিষ্ঠের। ফেসবুক অনুবাদে যখন অনেকে কাজ করতেন, তখন কলেজের অনুবাদে মহাবিদ্যালয় লিখতেন, কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি সন্তান কলেজের অনুবাদে কলেজকেই ভোট দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আপাতত একটা শব্দই গ্রহণ করেছে, open university না বলে লোকজন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বলে। এই ওপেন চালু না হয়ে যে উন্মুক্ত চালু হয়েছে তা থেকেই আমার মনে হয় বাংলা শব্দ চালু করলে লোকজন গ্রহণ করবে। কিন্তু নতুন শব্দ একটি ভাষায় যখন আসে তখনই তার অনুবাদ করে সেটি চালু করা দরকার। যখন বাইসাইকেল এসেছিল, সাথে Van ও এসেছিল, তখনই শব্দ দুইটার বাংলা চালু করলে আজকে ভ্যানের বাংলা বা বাইসাইকেলের বাংলা খুঁজতে হতো না।

আমি নিজেও একসময় বিশ্ববিদ্যালয় আর মহাবিদ্যালয় লিখতাম। পরে বাদ দিয়েছি। আমি যখন Utopia নিয়ে লিখি তখন কল্পলোক শব্দটি দিয়ে করেছিলাম। এখন গুগল অনুবাদ কল্পলোক দেখায়। একেবারেই সাম্প্রতিক কোনো বিদেশি শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহারের প্রয়োজন হলে, সেই বিদেশি শব্দটির অনুদিত বাংলা শব্দ চালু করা দরকার।

বাঙালি মধ্যবিত্ত খুব পরিচয় সঙ্কটে ভুগছে, যতদিন আত্মমর্যাদাবোধ ফিরে না আসবে ততদিন এই ঝামেলা থাকবে। আত্মমর্যাদা বলে যদি কিছু থেকে থাকে তা বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ই লালন করে না মনে হয়। এরা একেক সময় একেক পরিচয় ধারণ করে, মোগল আমলে ছিল তুর্কি পাঠান মোগল বা আশরাফ, ব্রিটিশ আমলে [কলকাতার] বাবু বা সাহেব, পাকিস্তানি আমলে পাকিস্তানি এখন আগে বাঙালি না আগে মুসলমান/ হিন্দু। এইসব পরিচয় সংকটের ফলে মধ্যবিত্তের পরিচয় সংক্রান্ত ঝামেলাটি আছে। আর ভাষার লিখিত রূপ তো মধ্যবিত্তেরই।

ফেব্রুয়ারি আসছে। টিফিন ক্যারিয়ার প্রসঙ্গে আরেকটু কথা বলা যায়। বাঙলায় পেঁটরা, পুটলি, ঝোলা এবং থলেএই চারটা শব্দ ছিলো। এখনকার পোলাপান এই শব্দগুলা একটাও চিনবে বলে মনে হয় না। অথচ এইগুলাকে যদি box বা Carrier-এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেত তাইলে বাংলা শব্দগুলা বাঁচত। কিন্তু হয়েছে কী তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। ইউরোপে Structuralism বলে একটি মতবাদ ১৯৬০-এর দশকে ছিলো। সেটি শব্দগুলোর অর্থ নির্দিষ্ট করে দেয়। আমাদেরও সেরকম বিদেশি শব্দগুলার ক্ষেত্রে দেশি কোন শব্দটা ব্যবহার করা হবে তা ঠিক করে দিয়ে প্রচারমাধ্যমে সেই শব্দগুলা চালু করলেই হবে। বাংলা পরিভাষার জয় হোক।

সোমবার, ডিসেম্বর ২৬, ২০২২

সত্য হচ্ছে ধ্যান-ধারণা ও নৈর্বক্তিক বাস্তবতার অনুরূপতা

 


ধ্যান-ধারণা ও নৈর্বক্তিক বাস্তবতার অনুরূপতাই সত্য। এধরনের অনুরূপতা সাধারণত আংশিক ও সন্নিকটবর্তী হয়। কোন সত্যকে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি তা সব সময়েই সত্য আবিষ্কার করার ও তাকে প্রকাশ করার জন্য আমাদের হাতে যে উপায়গুলি আছে তাদের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু তারই সঙ্গে এই অর্থে আপেক্ষিক হলেও ধ্যান-ধারণার সত্যতা সেই সমস্ত নৈর্বক্তিক তথ্যের ওপর নির্ভর করে যাদের সঙ্গে ঐ ধ্যান-ধারণার সাদৃশ্য রয়েছে। আমরা কখনোই পরিপূর্ণ, সম্পূর্ণ বা চরম সত্যকে জানতে পারি না, কিন্তু সর্বদা তার দিকেই এগিয়ে চলেছি।

ট্রুথ অর্থে সত্য শব্দটি প্রাচীন দাস যুগ থেকেই আছে। আর সমস্ত চিন্তারই শ্রেণি চরিত্র আছে। আর বিজ্ঞান দাস যুগে ছিলো, সামন্তযুগে পিছিয়ে গেছিল, তখন আলকেমি এবং আরো কিছু ব্যাপার ছিলো, তবে বিজ্ঞান ছিলো না মনে হয়। বিজ্ঞানকে বুর্জোয়ারা পুনরায় বাঁচিয়ে তোলে। মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা বিজ্ঞানকে অধীন করে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের, মাওবাদীরা অধীন করে দ্বন্দ্ববাদের। আর দর্শন হচ্ছে প্রকৃতি-বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের ঘনীভূত রূপ। ফলে শুধু বিজ্ঞানের পূজারিরা এখন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক হতে বাধ্য। একটি মজার প্রসঙ্গ, মোহনদাস গান্ধীর মতো পাজীর আত্মজীবনীর নাম মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ

চরম ও আংশিক সত্য

আমরা দেখেছি যে, ধ্যান-ধারণার বিকাশে হরেক রকমের অধ্যাসের যেমন উদ্ভব হয়, তেমনি সত্যেরও আবির্ভাব ঘটে। তাহলে সত্য বস্তুটি কী? এটি হলো ধ্যান-ধারণা ও নৈর্বক্তিক বাস্তবতার মধ্যে অনুরূপতা, ঐক্য বা সাদৃশ্য।

আমাদের ধ্যান-ধারণা ও বাস্তবতার মধ্যে এই অনুরূপতা, ঐক্য বা সাদৃশ্য কিন্তু একমাত্র ধীরে ধীরেই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাও আবার প্রায়শঃই আংশিক ও অসম্পূর্ণ অনুরূপতা, ঐক্য বা সাদৃশ্যের বেশি নয়। কারণ, একটি ধারণা বা ভাব সমস্ত দিক থেকেই তার বাস্তব বিষয়ের অনুরূপ নাও হতে পারে, কিন্তু আংশিক অনুরূপ হতে পারে; আবার ঐ বিষয়ে এমন অনেক কিছুই থাকতে পারে যা ধারণায় আদৌ স্থান পায় না, যার ফলে ধারণা ও তার নৈর্বক্তিক বস্তুর অনুরূপতা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এইসব ক্ষেত্রে অবশ্য একথা আমাদের বলা উচিত নয় যে আমাদের ধারণাটাই ভুল ছিল, কিন্তু তাহলেও তা সর্বাংশে, সম্পূর্ণভাবে চরম সত্য বলে বিবেচিত হবে না। অতএব, সত্য এমন কোনো সম্পত্তি নয় যে একটি ধারণা বা প্রতিজ্ঞা, হয় তার অধিকারী, নয় তো তা নয়; একটি নির্দিষ্ট মাত্রায়, নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সত্য একটি ধারণার উপাদান হতে পারে।

তথ্যসূত্র

১. মরিস কর্নফোর্থ, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, অনুবাদ ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, প্রকাশকাল নভেম্বর ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৫৩২-৫৩৩। 

সাম্যবাদ ও ধর্মের পার্থক্য লেখ



১. সাম্যবাদ ব্যক্তিমালিকানাকে অস্বীকার করে থাকে। কিন্তু সকল ধর্মই সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকার করে।

২. সাম্যবাদ বলে বস্তুর বিকাশের ফলে চেতনা এসেছে, ধর্ম উল্টোভাবে বলে যে চেতনা থেকে বস্তু এসেছে পরম চেতনা সব বস্তু তৈরি করেছে।

৩. সাম্যবাদ নারী-পুরুষে ভেদ করে না, কিন্তু বেশিরভাগ ধর্ম নারী-পুরুষের সামাজিক-রাজনৈতিকসহ বহু বিভেদ তৈরি করে। কিছু ধর্ম তো নারীকে বুদ্ধিহীন প্রাণী হিসেবেই উপস্থাপন করে।

৪. সাম্যবাদ মুনাফা ও বৈষম্যের বিরোধী, কিন্তু ধর্ম মুনাফার স্বীকৃতি দেয় এবং ধনী-গরিবের বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখে।

৫. সাম্যবাদ বলে, এই পৃথিবীতেই লড়তে হবে, ধর্ম বলে পরকালের আশায় বসে থাকো।

কুসংস্কার এমন বিশ্বাস বা অনুশীলন যা অযৌক্তিক বা অতিপ্রাকৃত বলে বিবেচিত

 


কুসংস্কার (ইংরেজি: Superstition) হচ্ছে এমন কোনো বিশ্বাস বা অনুশীলন যা অ-চর্চাকারীদের দ্বারা অযৌক্তিক বা অতিপ্রাকৃত বলে বিবেচিত হয়, যেটি ভাগ্য বা জাদু, অনুভূত অতিপ্রাকৃত প্রভাব বা অজানা ভয়ের জন্য দায়ী হয়ে থাকে। এটি সাধারণত ভাগ্য, তাবিজ, জ্যোতিষশাস্ত্র, কপাল বলার, আত্মা এবং কিছু অলৌকিক সত্তাকে ঘিরে বিশ্বাস এবং অনুশীলনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, বিশেষ করে এই বিশ্বাস যে ভবিষ্যতের ঘটনাগুলি নির্দিষ্ট (আপাতদৃষ্টিতে) সম্পর্কহীন পূর্বতন ঘটনাগুলির দ্বারা ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে।

এছাড়াও, কুসংস্কার শব্দটি প্রায়শই এমন একটি ধর্মকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যা একটি প্রদত্ত সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা অনুশীলন করা হয় না; যদিও সেটা প্রচলিত ধর্ম হিসেবে টিকে থাকে এবং সংখ্যা গরিষ্ঠরা সেটাকে কুসংস্কার হিসেবে দেখে অথবা ধর্মবিরোধীদের দ্বারা সমস্ত ধর্মের জন্য সেটাকে কুসংস্কার হিসেবে দেখানো হয়। মধ্যযুগীয় বর্বর ইউরোপে ডাইনি শিকারের ঘটনাগুলি সাধারণত ধর্মীয় কুসংস্কার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। 

কুসংস্কার হিসাবে বিকল্প ধর্মীয় বিশ্বাস

একটি প্রদত্ত সংস্কৃতিতে সাধারণভাবে গৃহীত ধর্ম থেকে ভিন্ন ধর্মীয় অনুশীলনকে কখনও কখনও কুসংস্কার বলা হয়; একইভাবে, একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আনা নতুন অনুশীলনগুলিকে বাদ দেওয়ার প্রয়াসে নতুন অনুশীলনগুলোকে কুসংস্কার হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। একইভাবে, ভক্তির অত্যধিক প্রদর্শনকে প্রায়ই কুসংস্কারপূর্ণ আচরণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রাচীনকালে, ল্যাটিন superstitio শব্দটি, এর সমতুল্য গ্রীক deisidaimonia শব্দটির মতো, অতিরঞ্জিত আচার এবং ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি অত্যধিক বিশ্বাসপ্রবণ মনোভাবের সাথে যুক্ত ছিল। গ্রীক এবং রোমান বহুঈশ্বরবাদীরা, যারা রাজনৈতিক এবং সামাজিক শর্তে দেবতার সাথে তাদের সম্পর্কের মডেল তৈরি করেছিল, সেই ব্যক্তিকে তিরস্কার করত যে ক্রমাগত দেবতাদের চিন্তায় ভয়ে কাঁপত, যেমন একজন ক্রীতদাস একজন নিষ্ঠুর এবং খামখেয়ালী প্রভুকে ভয় পায়। দেবতাদের প্রতি এমন ভয়কেই রোমানরা কুসংস্কাররূপে বোঝাত (Veyne 1987, p. 211)দিদেরো তাঁর Encyclopédie-তে কুসংস্কারকে সাধারণভাবে ধর্মের যে কোনো বাড়াবাড়ি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এবং এটিকে বিশেষভাবে পৌত্তলিকতার সাথে যুক্ত করেছিলেন।

কুসংস্কারজীবী প্রসঙ্গে

সমাজে কিছু জীবিকা নির্বাহী মানুষ আছে, যারা কুসংস্কার বিক্রি করে বেঁচে থাকে, যেমন তাবিজ, কবচ, যাদু টোনা, ভুত প্রেত থেকে ঝাড়ফুঁক, এমনকি বন্য প্রাণীর দেহ বা দেহাবশেষ ওষুধ হিসেবে বিক্রি করে। এরাই মূলত কুসংস্কারজীবি। পরিস্থিতির জটিলতায় হয়ত এরা এমন জীবনে এসেছেন, এরা লুম্পেন অনেকটা আর পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পুরোটা। মানবতাবাদ শুধু মানুষের মঙ্গল দেখেছে, ফলে মানবতাবাদীর কাছে পণ্য বা মুনাফা খারাপ কিছু নয়। ফলে মানবতাবাদীরা যে কোনো ব্যবসাকেই বৈধ বলে। সেটি যত বিপন্ন প্রাণীর ব্যবসাই হোক না কেন, সেই ব্যবসাও তারা চালাতে চায়।

সামন্তবাদ আর কুসংস্কারের সম্পর্ক একটি আঠালো সম্পর্ক। ফলে একজন কুসংস্কারজীবী কোনোভাবেই সমাজের কাজে লাগে না, কুসংস্কারজীবীরা কলা বা ঝালমুড়ি বেচেও জীবনধারণ করতে পারে।

রবিবার, ডিসেম্বর ২৫, ২০২২

স্মৃতিময় সিটিসেল

সিটিসেল


সিটিসেল নামে ব্যবসা করেছে প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড, যেটি ছিল বাংলাদেশের প্রাচীনতম মোবাইল অপারেটর। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল অপারেটর কোম্পানি ও দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রগামী টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক কোম্পানি যা শ্রীলঙ্কার ইতিসালাত ও পাকিস্তানের পাকটেলের মতোই বাংলাদেশে প্রথমে ব্যবসা আরম্ভ করে। এটি দেশের একমাত্র মোবাইল অপারেটর যা সিডিএমএ এবং ইভিডিও প্রযুক্তি ব্যবহার করত। আগস্ট ২০১৬ পর্যন্ত সিটিসেলের মোট মোবাইল গ্রাহক ছিল ১ লাখ ৪২ হাজার।

আমার ব্যক্তিগত জীবনের একটি অংশ জুড়ে আছে এই সিটিসেল। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে একটি ছাইরঙা ছোট এন্টিনার সেট কিনে সিটিসেলের গ্রাহক হই। সেইটিতে যে রিম ছিলো তা পোস্টপেইড। যখন গেঁড়ামিন নামক বাটপার অপারেটরটায় সাত টাকা মিনিট কথা বলতে হতো তখন আমি কথা বলতাম সাড়ে তিন টাকায়। ফলে তখন কথা বলেছি অনেক, আমার সাড়ে ছয় হাজার টাকা বেতনের ৫০০-৭০০ টাকা চলে যেত কথা বলতে। আমার কলিগ পর্যন্ত আমার সেই সিটিসেলেই কথা বলতো। তাঁর যুক্তি ছিলো আমারটায় কম রেট!

আমি সিটিসেল কিনেছিলাম তাঁর কারণ আমার বড় ভাইয়ের প্রথম সেটটিও সিটিসেল ছিলো। তাঁর সেটটিতে কোনো রিম ছিলো না। ভাইয়ের ফোনটির দাম ছিলো প্রায় ১০ হাজার টাকা। এরপর বিভিন্ন সময় সিটিসেলের কলরেট কমতে থাকে। কমতে কমতে একসময় সিটিসেল টু সিটিসেল ২৯ পয়সা মিনিটে এসে থামে। যাদের সাথে বেশি কথা বলতে হয় তাঁদেরকে আমি একটি করে ৯৯০ টাকার সেট গিফট করতে থাকি। এরকমভাবে আমাদের পুরো পরিবার হয়ে যায় সিটিসেল পরিবার।

সিটিসেল দিয়ে তারুণ্যের উত্তাল দিনগুলোতে পেয়েছি বন্ধুত্ব, প্রেম, মুগ্ধতা। এই সিটিসেলে কথা বলেই খুঁজে পেয়েছিলাম আমার পরমাত্মীয়টিকে। পুরনো সিটিসেল বন্ধ হওয়া তাই ছিলো আনন্দ-বেদনার সাথে জড়িয়ে।

নির্মলেন্দু গুণ মোবাইলের বার্তা বক্সে লিখেছিলেন মুঠোফোনের কাব্য, আর আমি লিখেছিলাম প্রায় ৩০০টি প্রেমবার্তা। তখন দশ-বিশ মিনিটে চার-পাঁচ লাইনের কবিতা লিখে ফেলতাম

সিটিসেল বন্ধ হলো যেদিন মহামহিম তাঁড়ানা আপা আঙ্গুলের ছাপ্পা নিতে শুরু করলেন। আমরা আর কেউই সিটিসেলের জন্য ছাপ্পা দিলাম না। তখনো দেখি পরিবারের একজন সদস্য সিটিসেলটির জন্য ছাপ্পা দিয়েছেন।

সবাই সিটিসেল বর্জন করলেও আমি শেষ পর্যন্ত বর্জন করতে পারিনি। বাটপার গেঁড়ামিন আমি জীবনে একবছরও ব্যবহার করতে পারিনি। আর বদমাশ বাংলালিংক ব্যবহার করতাম বিকল্প নম্বর হিসেবে। পকেটে একটি সিটিসেল সেট রাখতাম ২০১৫ সালেও। আর সিটিসেল সস্তায় যে ইন্টারনেট সেবা দিত তা কখনই ভুলবার নয়।

সতীশ পাকড়াশী ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা

বিপ্লবী সতীশচন্দ্র পাকড়াশী (১৩ ডিসেম্বর ১৮৯১  ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৭৩) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং বাঙালি সশস্ত্র বিপ্লববাদী মুক্তিযোদ্ধা।

ছাত্র থাকাকালীন মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি প্রখ্যাত বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী মহারাজের সংস্পর্শে আসেন। তার ফলশ্রুতিতে ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় তিনি তৎকালীন গোপন বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতির সদস্য হন। তাঁদের চেষ্টায় পার্শ্ববর্তী সাটিরপাড়া গ্রামে অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে তারা লাঠি, ছুরি এবং ড্রিল নিয়ে শারীরিক ব্যায়ামের জন্য নিয়মিত জড়ো হতে থাকেন। প্রমথনাথ মিত্র যুবকদের বলেছিলেন যে বিদেশী পণ্যের বিরুদ্ধে পিকেটিং দিয়ে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না, যা শুধুমাত্র সহিংস বিদ্রোহ দ্বারা স্বাধীনতা অর্জন করা যেতে পারে; তাই দলে দলে নিজেকে সংগঠিত করতে হবে। তাই তারা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরেন। 

সতীশ পাকড়াশী ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেন ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে। ঐ বছরই অস্ত্র আইনে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করা আরম্ভ করেন। মুক্তি পেয়ে নরসিংদীতে ফিরে এসে আবার গোপন দলের কাজে যোগ দেন। তাকে মালদহে পাঠানো হয়। ১৯১৪ সালে তিনি কলকাতা যান। তৎকালীন আধুনিক বর্বর ব্রিটিশ সরকার একাধিক রাজনৈতিক ডাকাতির অপরাধে তার নামে ওয়ারেন্ট জারি করেছিল।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় পুলিশের দমননীতির জন্যে সহকর্মী নলিনীকান্ত বাগচীর সাথে আত্মগোপনে চলে যান। সমিতির আরো কয়েকজন সদস্যসহ তারা আসামের গৌহাটিতে গিয়ে সেখান থেকে সারা বাংলাদেশের সশস্ত্র বিপ্লবের কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। পুলিশ ১২ জানুয়ারি ১৯১৮ তারিখে তাদের গোপন আস্তানা ঘিরে ফেললে তারা ৭ জন নিকটের নবগ্রহ পাহাড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং পুলিশবাহিনীর সাথে রিভলভার নিয়ে যুদ্ধ করতে থাকেন। ৫ জন ধরা পড়লেও তিনি ও নলিনীকান্ত বাগচি পালাতে সক্ষম হন। দুজনেই পদব্রজে কলকাতায় চলে যান। নলিনীকান্ত বাগচি এই ঘটনার কিছুকাল পরেই ঢাকা শহরে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।

সতীশ পাকড়াশী ১৯১৮ সালে কলকাতায় ধরা পড়লে প্রথমে তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেল ও পরে রাজশাহী জেলে বন্দি করে রাখা হয়। তিন বছর পরে তিনি মুক্তি পান। ১৯২৩ সালে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে আগত অবনী মুখোপাধ্যায়ের সাথে তাকে রাশিয়ায় পাঠানোর চেষ্টা করে সমিতি, তবে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আবার গ্রেফতার হন এবং রাজবন্দী হিসেবে ৫ বছর জেল খাটেন। এই সময় তিনি আলিপুর, মেদিনীপুর, ঢাকা, মহারাষ্ট্রের যারবেদা এবং কর্ণাটকের বেলগাঁও জেলে বন্দি থাকেন। ১৯২৯ সালে মেছুয়াবাজার বোমা মামলায় পুনরায় গ্রেপ্তার হন। তাকে আন্দামান সেলুলার জেলে দ্বীপান্তর করা হয়। ১৯৩৩ থেকে পরবর্তী ছয় বছর সেলুলার জেলে বন্দি থাকেন। এই সময় তিনি সাম্যবাদে আকৃষ্ট হন। তার জীবনের ৩২ বছর কারান্তরালে কেটেছে। ১১ বছর আত্মগোপন করে ছিলেন।

সেলুলার জেলে কমিউনিস্ট কনসলিডেশনের সদস্য ছিলেন। জেলখানায় সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ নিয়ে পড়াশোনা করতেন। কারামুক্তির পর ১৯৩৮ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। পার্টি নিষিদ্ধ হলে আত্মগোপন করেন। বক্সা দুর্গে বন্দী ছিলেন অন্যান্য সাম্যবাদী বিপ্লবীদের সাথে। ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাগ হলে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)তে যোগ দেন। পরে পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। বিপ্লবী সতীশচন্দ্র পাকড়াশী ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৭৩ তারিখে মারা যান।

ব্যক্তিগত একটি স্মৃতি

২০০৬-০৭ সাল হবেনরসিংদী গেছি। নরসিংদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা একদিন বিকেলে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলেন। এদিক-সেদিক এই রাস্তা সেই রাস্তা ঘুরিয়ে কোনো এক গ্রামের একটি বিশাল বটগাছের পাশে গাড়ি দাড় করালেন। গাছের থেকে একটু দূরে ঝোপঝাড়ের মাঝখানে এক পুরনো মন্দির। তিনি এরকম এক জায়গায় দাড়িয়ে বললেনএই অঞ্চলে ৪০-৫০ বছর আগেও ঘন জংগল ছিলোএসব জায়গায় লুকিয়ে থাকতেন সে সময়ের ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীরা। সতীশচন্দ্র পাকড়াশী নামে এক বিপ্লবী পাশেই জন্মেছিলেন। তিনি এসব জায়গায় লুকিয়ে থেকেই কাজ করতেন।

সেই থেকে চিনি তাঁকে। শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী সতীশচন্দ্র পাকড়াশীর প্রতি। আজ বাংলাদেশে অজস্র তুচ্ছ আর ইতরেরা মহামহিম সেজেছে মুখোশের আড়ালেঅথচ এই বিপ্লবীদের কে মনে রেখেছে?

নিকোলাই অস্ত্রভস্কি ছিলেন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী লেখক

 


নিকোলাই আলেক্সিভিচ অস্ত্রভস্কি (রাশিয়ান: Никола́й Алексе́евич Остро́вский; ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ - ২২ ডিসেম্বর ১৯৩৬) ছিলেন ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী লেখক। তিনি তার উপন্যাস ইস্পাত-এর (ইংরেজি:How the Steel Was Tempered)  জন্য সর্বাধিক পরিচিত।

নিকোলাই অস্ত্রভস্কি মনে করতেন, জীবন এক অনন্য সৃষ্টি, একে কোনোভাবেই হেলাফেলায় নষ্ট করা উচিত নয়। সংগ্রামময় এই জীবনের ধাপে ধাপে বিভিন্ন পদ্ধতিতে আমরা সচেতন প্রয়াস করে থাকি নিজেদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। দায়িত্বে, সামাজিকতায়, কর্তব্যবোধ সম্পন্ন একজন ব্যক্তি কখনোই পিছপা হন না। যতই প্রতিবন্ধকতা আসুক তিনি দৃঢ় মনোবল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, মুখোমুখি হন, জয় করেন বা পরাজয় থেকে শিক্ষা নেন আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য।

সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় যিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সম্মান অর্ডার অব লেনিন’-এ পুরস্কৃত হয়েছিলেন। মাত্র ৩২ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ছিল সংগ্রামমুখর। শ্রমিক পরিবারে জন্ম, বেড়ে ওঠা। সোভিয়েত বলশেভিক আদর্শকে জীবন দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন।

নিকোলাই অস্ত্রভস্কি মাত্র ১৩ বছর বয়সেই পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। বহুবার যুদ্ধে অংশ নেন। আহত হন। তাতেও দমে যাননি। কিন্তু মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শেষে চোখ হারান দৈহিক শক্তি হারান। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতাময় জীবন যে তাকে পঙ্গু করে দেয় তা নয়। মহান লেনিনের আদর্শ থেকে তিনি শিখেছিলেন জীবন কত গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা।

ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা থেকে শুরু করলেন নিজের লেখনী। জয় করলেন দুনিয়াকে, তার প্রথম উপন্যাস ইস্পাত দিয়ে। পাভেল নামের এক চরিত্র কিভাবে ছোট থেকেই সংগ্রাম করতে করতে বড় হচ্ছেন, বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়াচ্ছেন, শত্রুপক্ষ কে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন, আবার এই সবের মধ্যে তিনি শারীরিক ভাবে প্রায় অকেজো হয়ে পড়ছেন, তবু ভাবছেন কিভাবে এই সমস্ত কিছুকে তুচ্ছ করে জীবনের আনন্দ পাওয়া যায় সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্রতী হওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে নিকোলাই তার নিজের জীবনকেই এই উপন্যাসের পাভেল চরিত্রের মধ্য দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন। জীবনের  শেষ পর্যায়ে সোভিয়েতের বড় বড় হাসপাতালে তার চিকিৎসা হলেও তাকে বাচাঁনো যায়নি। দুরারোগ্য ব্যাধি তার প্রাণ কেড়ে নেয়।

১৯৩৬ সালের ২২ সে ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু মৃত্যু হয়নি তার আদর্শের, তার সৃষ্টির। তিনি বলেছিলেন জীবন মানুষের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ। আর জীবন মানুষ পায় মাত্র একটিবার। তাই এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে মানুষ বলতে পারে আমি আমার সমগ্র জীবন ব্যায় করেছি মানুষের মুক্তি সংগ্রামে, মানুষকে ভালোবেসে।

জীবন এবং মৃত্যু সম্পর্কে নিকোলাই অস্ত্রভস্কির এই গভীর ধারণা তাই এখনও অসংখ্য সংগ্রামী মানুষের চলবার শক্তি এগিয়ে যাবার প্রেরণা। বিশ্বের দেশে দেশে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বা ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিটি সংগ্রামে নিকোলাই এর জীবনবোধ আমাদের এগিয়ে দেবে প্রতিটি লড়াইয়ে। তিনি বাঙ্ময় হয়ে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, আমাদের দৃপ্ত পথচলায়।


বিপ্লব প্রতিরোধের সাম্রাজ্যবাদী অভিজ্ঞতা

 


ফরাসি বিপ্লবের পরে ফ্রান্সের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল ইউরোপীয় বুর্জোয়ারা। যুদ্ধ চাপিয়ে মুনাফা কামানো এবং বিপ্লব বিরোধিতার অভিজ্ঞতা তাঁদের তখনই হয়েছিল। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়াকে আক্রমণ করতে তাই ইউরোপীয় বুর্জোয়ারা দেরি করেনি। ইউরোপে বিভিন্ন দেশের সরকার এবং প্রতিষ্ঠানকে উচ্চ সুদে ঋণদানই ছিল রথচাইল্ড পরিবার নামে একটি সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসী পরিবার। এর পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের ব্যবসাও ছিল তাদের। বলা হয়ে থাকে, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে উভয় সরকারকেই ঋণ দিতো রথসচাইল্ড। বিনিময়ে বন্ধক রাখতে হতো রাষ্ট্রের জমিজমা আর ধন-সম্পদ।  

ফরাসি বিপ্লবের পরে ফ্রান্স এবং ‍ব্রিটেনের মধ্যকার ওয়াটারলুর যুদ্ধে দুই দেশকেই ঋণ দিয়েছিল এই যুদ্ধংদেহী বর্বর পরিবারটি। সেইই যুদ্ধে কেবল ১৮১৫ সালেই ইংল্যান্ডের মিত্রদের ৯৮ লাখ পাউন্ড ঋণ দিয়েছিল তারা, বর্তমান হিসাবে তা প্রায় ১ হাজার ১ কোটি মার্কিন ডলারের সমান। সেইসময় এর পাশাপাশি আরো একটি লাভজনক ব্যবসা চালাতে পেরেছিল রথসচাইল্ড পরিবার। ওয়াটারলুর যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে সব ধরনের জাহাজ চলাচলই বন্ধ ছিল। চলতো কেবল এই পরিবারটির জাহাজ। কারণ দুই দেশের সরকারই তাদের জাহাজের নিরাপত্তা দিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের বিশেষভাবে ফ্রান্স এবং ইটালির কমিউনিস্ট পার্টি ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু এই মেরুদণ্ডবিহীন নপুংসক সংশোধনবাদীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্ষমতা দখল না করে বসে বসে আঙুল চুষছিল। যার ফলাফল বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের জন্য খুব ক্ষতিকর হয়েছিল।

অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকছে বুর্জোয়ারা। লেনিন যে বলেছিলেন সমস্ত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রলেতারিয়েত হয়ে উঠবে অগ্রণী শ্রেণি, তা বাংলাদেশে কী পর্যায়ে আছে? বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই  শ্রমিক ও কৃষকগণ আন্দোলনে অস্ত্র হাতে তুলে নেন, কিন্তু তারপরও শান্তিবাদী হয়ে থাকে কেন কমিউনিস্টরা? কেন তারা দুদিনের হরতাল পর্যন্ত ডাকে না? এই প্রশ্নের উত্তর পেলেই বোঝা যাবে এইখানে কমিউনিস্ট নামধারী নেতারা মার্কস-লেনিনকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলেছেন!

বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ প্রধান শত্রু। এখানে মৌলবাদ তাঁর জানের দোস্ত। ফুকুয়ামার মতবাদ অনুসারে সাম্রাজ্যবাদ চলছে সভ্যতার সংঘর্ষকে কার্যকর করতে। এই দ্বন্দ্বের জন্য সাম্রাজ্যবাদ মৌলবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধ শক্তিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারলে আমরা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই চালাতে পারব। দ্বন্দ্ব নিয়ে যদি বস্তু তৈরি হয় তবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধ শক্তিকে মিলেই একটি বস্তু তৈরি হয়।

তথ্যসূত্র

১. রাশেদ শাওন, ৬ জুন, ২০১৭, গোনিউজ২৪.কম, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী, সবচেয়ে রহস্যময় রথচাইল্ড পরিবারের উত্থান, ইউআরএল: https://www.gonews24.com/international/news/26734/

সাম্রাজ্যবাদীদের হত্যাকে ধর্মীয় পরিচয় দেয়া যাবে না

 


ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়া, ফিলিপাইন, চিলি, নিকারুগুয়া, নাইজেরিয়া ইত্যাদি দেশে কোটি কোটি মানুষ হত্যা করেছে সাম্রাজ্যবাদীরা। তাদের কিন্তু বৌদ্ধ বা নাস্তিক হিসেবে হত্যা করা হয় নি।

সংখ্যার বিচারে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয়েছে, নিহত হয়েছে এসব যারা বলেন, তারা আসলে সাম্রাজ্যবাদীদের তৈরি করা আখ্যান অনুসারে কথা বলেন। সাম্রাজ্যবাদীরা চায় নিপীড়িতেরা ধর্মীয় পরিচয়ে নিজেদের পরিচিতি দিক, যাতে হত্যাকে আধুনিক বর্বর ইউরোপীয় চিন্তার লোকজনের কাছে বৈধ করা যায়।

আমাদেরকে বলতে হবে, লিখতে হবে যে, গরিবদের নিপীড়িতদের শোষিতদের হত্যা করা হয়েছে। মুসলমান বা ধর্মীয় পরিচয় সামনে আনলে সাম্রাজ্যবাদীদের সুবিধা হয়। নিপীড়িতের বা গরিবের প্রতিবাদকে মুসলমানদের বলে চালালে সাম্রাজ্যবাদীদের তৈরি করা ন্যারেটিভ দিয়েই প্রতিবাদ করা হয়। এতে কাজ হয় খুব অল্প। বিশ শতকে দুটি বড় সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধের বিপরীতে লড়াই করে জয়ী হয়েছিলেন, লেনিন, স্তালিন ও মাও সেতুং। আমরা তাঁদের দেখানো পথে চলি, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিশ্ব গড়ি।

তবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন কীভাবে হবে এই নিয়ে একটা কৌতুক পড়া যেতে পারে:

দুই বিপ্লবীর তুমুল বিতর্ক চলছে
১ম বিপ্লবী: সাংস্কৃতিক সংগ্রাম দিয়েই কেবল সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করা সম্ভব। আমাদের সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে জোরদার করতে হবে।

২য় বিপ্লবী: আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে সশস্ত্র বিপ্লবের বিরোধিতা করা। সশস্ত্র হলে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ বিপ্লবীদের আক্রমণ করার সুযোগ পায়। ফলে সশস্ত্র সংগ্রাম পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদকে শক্তিশালী করে।

৩য় বিপ্লবী: আপনাদের বিতর্ক থেকে বুঝলাম রবীন্দ্রসংগীত আমাদের বিপ্লবের প্রধান অস্ত্র। জয় রবীন্দ্রসংগীতের জয়।

শনিবার, ডিসেম্বর ২৪, ২০২২

অনুপ সাদির খোলা চিঠি


বন্ধুরা
,

আমি ফেসবুকে একাউন্ট খুলি ২৮ অক্টোবর, ২০১১ তারিখে। এই কাজটির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ভালো লেগেছিল। এটি চালাতে গিয়ে আমাকে নানা কাজ শিখতে হয়েছে। সেই কাজগুলোকে আনন্দের সাথেই এখনও করে চলছি। এই কাজগুলো নিজের জন্য যতটুকু করেছি, আপনাদের এবং মানুষের জন্য করেছি তার চেয়েও বেশি। কাজগুলোর তালিকা নিচে দিলাম।

১. আমি এখন ফটোশপের কাজ পারি। আপনারা অবাক হবেন যে আমি ফটোশপ সিসি ব্যবহার করি।
২. অভ্র ব্যবহার করে দ্রুত বাংলা লিখতে পারি।
৩. ই-বই বানাতে পারি।
৪. আমি বাংলা উইকিপিডিয়াতে যুক্ত করেছি ১৬০০টি নতুন নিবন্ধ। বাংলাভাষী জনগণের জন্য তথ্যকে সহজলভ্য করতে নিজের দায় থেকে আমি এটি করেছি। বাংলা উইকিতে মাত্র এখন প্রায় ১৩২,০০০ নিবন্ধ আছে। আমি একাই যুক্ত করেছি ১৬০০টি যা ভেবে আমি নিজেই আনন্দ পাই। উইকিতে সম্পাদনা করেছি প্রায় ৫০০০০।

আমার আগের ফেসবুক একাউন্টটি বন্ধ করার পরে নতুন একাউন্ট হয়। আজ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে এসে বলতে পারি আমার লেখা প্রতিদিন হাজার হাজার জন পড়ে থাকেন। এই বিপুল পাঠকের প্রতাশা হয়তো আমি পূরণ করতে পারি না। আমি চাই আমার পাঠকেরা আমার সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝে উঠুক। তারা গণতান্ত্রিক, সৃজনশীল, শুভবুদ্ধির শ্রমমুখি হয়ে উঠুক। তাদের প্রত্যাশাগুলো লক্ষ শ্রমিক-কৃষকের প্রত্যাশার সাথে মিলিত হোক

আমি এই সময়টিতে যে শ্রম দিয়েছি তা সম্ভব হয়েছে আপনাদের সহযোগিতায়। আপনারা পড়েন বিধায় আমি লিখতে চাই। এই সময় আমি প্রকাশকদের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমার বই বইমেলাতে আসবে কীনা তা টের পাই না। আমার লেখা বিতর্কও হয়তো তৈরি করতে পারে না। কিন্তু আমি মনে করি জনগণের পক্ষে থেকে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি জনমত তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে সেই জনমত তৈরির চেষ্টায় এগিয়ে যাওয়া বড় কথা নয়, এই সুবিধাবাদের যুগে শ্রমিকের পক্ষে থেকে কাজ করাটাই প্রধান লড়াই।

ওয়েবসাইট ও ব্লগ হওয়ায় আমি এখন অনেকটাই স্বাধীন। কিন্তু আমি ব্লগ-ফেসবুকের এই জগতটিতে বিচরণ শুরু করি অনেকের পরে। কিন্তু যে দ্রুত আমি এই জগতটিকে বুঝতে পেরেছি তা আমার কাছে ভালই লাগে। এখন আমি প্রতিদিনই কিছু লিখতে চেষ্টা করি। পুরোনো লেখাগুলোকে হাজির করি। এভাবেই আমি আমার প্রায় সব লেখাকে অনলাইনে প্রকাশ করেছি আমি আমার চারটি বইকে ই-বই আকারে হাজির করেছি এবং একটি ই-বই সংকলন করেছি। সেগুলোও আপনারা পেয়ে থাকবেন এছাড়া আরো বেশ কয়েকটি ই-বই তৈরির কাজ চলছে। এছাড়াও আমার ১২ টি বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার জীবনের দীর্ঘ এই এগারটি বছর দিয়েছি আমি বাংলা ভাষার লক্ষ পাঠকের সাথে আমার কিছু পছন্দের বিষয়কে ছড়িয়ে দেবার জন্য।

আর এতসব কাজ করতে গিয়ে কিছু ভার্চুয়াল শত্রুও জুটিয়েছি। সেই শত্রুরা আমার কোনো ব্যক্তিগত শত্রু নয়। তাঁরা আমার আদর্শিক শত্রু। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমি অনবরত লিখে গেছি। আমি সকল রকমের ব্যবসার ধ্বংস কামনা করি। আশা করি আমার ভার্চুয়াল এবং বাস্তবের সব বন্ধুরাই আমাকে আলোচনা ও সমালোচনার মাধ্যমে অতীতের মতোই সহযোগিতা করবেন। আপনাদের পরামর্শ আমাকে চলার পথের দিশা দেবে। জনগণের পথকে যেন আমরা আঁকড়ে থাকতে পারি। গণশত্রুদের পরাজয় অনিবার্য

অনুপ সাদি,
২৫ ডিসেম্বর, ২০২২, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ।

Featured Post

বাংলাদেশের পাখির তালিকা, A checklist of the birds of Bangladesh.

Oriental Magpie Robin; National Bird of Bangladesh বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর তালিকাটি অনেক সমৃদ্ধ। এদেশ পাখির দিক দিয়...