বাংলা ভাষায় আমরা ইংরেজি শব্দ অহরহ যুক্ত করি। এছাড়াও
বাংলায় অন্য ভাষা যেমন ফারসি ও পর্তুগীজ থেকেও অনেক শব্দ আত্মীকৃত করা হয়েছে।
কিন্তু এসবের খুব একটা প্রয়োজন কোনোকালেই ছিল না, এখনো নেই। চীনের বিভিন্ন ভাষায় র্যাম, হার্ড ডিস্ক, প্রসেসরসহ কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট সব
শব্দেরই নাকি একাধিক চীনা অনুদিত শব্দ আছে। বাংলাতেও সেসব সহজে ব্যবহার করা যেতে
পারে। এজন্য পরিভাষার বিকাশ খুব দ্রুত হওয়া দরকার।
যারা উপনিবেশবাদীদের অত্যাচারের শিকার হয়নি, তারা
স্বাধীনভাবেই নিজ ভাষাকে রক্ষা করে থাকে। আমার যেসব জাতি নয়া উপনিবেশবাদের শিকার
হচ্ছে না, তারাও নিজ ভাষাকে রক্ষা করতে পারছে। চীন এবং নেপাল হচ্ছে এমন দুটি দেশ
যারা নিজেদের ভাষাকে রক্ষা করছে। কিন্তু বাংলাদেশে উপনিবেশিক নিপীড়নের ফলে আত্মমর্যাদাহীনতার কারণে নিজ ভাষাতে ইংরেজি বা
অন্য ভাষার চিহ্নগুলো বাড়ছে। যেমন, নেপালীরা তাঁদের নিজস্ব ভাষাগুলিতেই কথা বলে।
তাদের নিজ ভাষাগুলোকে তারা মিশ্র ভাষা বা খিচুড়ি ভাষা করেনি। নেওয়ারী ভাষা, নেপালী
ভাষা,
ডোটেলি ভাষা ইত্যাদি সবগুলাই সংস্কৃত জাত, কিন্তু
ওরা বাংলা অঞ্চলের মতো বাংলা আর ইংরেজি মিশ্রিত করেনি।
আমরা চাইলেই কিছু শব্দ বাংলা চালু করা যেত,
পরিভাষাগুলোকে সংস্কার করা যেত, নতুন নতুন পরিভাষা সৃষ্টি করা যেত। যেমন, নেপালে
ঝোলা শব্দটা খুব চলে, কেউ ব্যাগ বলে না। এখন আমরা বলি টিফিন
ক্যারিয়ার, এটার বাংলা হওয়া দরকার। এটাকে
খাবার ঝোলা বলা যেতে পারে, যদিও টিফিন ক্যারিয়ারে জল থাকে না। জল রাখবার জক বা জগ
নামক পাত্র আছে যাহা পানির পট নামে সমধিক পরিচিত।
তবে বাঙালি মধ্যবিত্ত যেহেতু উৎস থেকেই দাসত্বে
অভ্যস্ত, তাই তাদের কাছে বাংলাটা ঠিক আসে না। তাই আমরা বলছি পরিভাষার গ্রহণ করার
মানসিকতা থাকা চাই সংখ্যাগরিষ্ঠের। ফেসবুক অনুবাদে যখন অনেকে কাজ করতেন, তখন কলেজের
অনুবাদে মহাবিদ্যালয় লিখতেন, কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি সন্তান কলেজের অনুবাদে কলেজকেই
ভোট দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আপাতত একটা শব্দই গ্রহণ করেছে, open
university না বলে লোকজন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বলে। এই ওপেন চালু
না হয়ে যে উন্মুক্ত চালু হয়েছে তা থেকেই আমার মনে হয় “বাংলা
শব্দ চালু করলে লোকজন গ্রহণ করবে”। কিন্তু
নতুন শব্দ একটি ভাষায় যখন আসে তখনই তার অনুবাদ করে সেটি চালু করা দরকার। যখন
বাইসাইকেল এসেছিল, সাথে Van ও
এসেছিল, তখনই শব্দ দুইটার বাংলা চালু করলে আজকে ভ্যানের
বাংলা বা বাইসাইকেলের বাংলা খুঁজতে হতো না।
আমি নিজেও একসময় বিশ্ববিদ্যালয় আর মহাবিদ্যালয় লিখতাম।
পরে বাদ দিয়েছি। আমি যখন Utopia নিয়ে লিখি তখন কল্পলোক শব্দটি
দিয়ে করেছিলাম। এখন গুগল অনুবাদ কল্পলোক দেখায়। একেবারেই সাম্প্রতিক কোনো বিদেশি
শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহারের প্রয়োজন হলে, সেই বিদেশি শব্দটির
অনুদিত বাংলা শব্দ চালু করা দরকার।
বাঙালি মধ্যবিত্ত খুব পরিচয় সঙ্কটে ভুগছে, যতদিন আত্মমর্যাদাবোধ ফিরে না আসবে ততদিন এই ঝামেলা থাকবে। আত্মমর্যাদা
বলে যদি কিছু থেকে থাকে তা বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ই লালন করে না মনে হয়। এরা
একেক সময় একেক পরিচয় ধারণ করে, মোগল আমলে ছিল তুর্কি পাঠান
মোগল বা আশরাফ, ব্রিটিশ আমলে [কলকাতার] বাবু বা সাহেব,
পাকিস্তানি আমলে পাকিস্তানি এখন আগে বাঙালি না আগে মুসলমান/ হিন্দু।
এইসব পরিচয় সংকটের ফলে মধ্যবিত্তের পরিচয় সংক্রান্ত ঝামেলাটি আছে। আর ভাষার লিখিত
রূপ তো মধ্যবিত্তেরই।
ফেব্রুয়ারি আসছে। টিফিন ক্যারিয়ার প্রসঙ্গে আরেকটু কথা
বলা যায়। বাঙলায় পেঁটরা, পুটলি, ঝোলা এবং
থলে–এই চারটা শব্দ ছিলো। এখনকার
পোলাপান এই শব্দগুলা একটাও চিনবে বলে মনে হয় না। অথচ এইগুলাকে যদি box বা Carrier-এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেত তাইলে বাংলা
শব্দগুলা বাঁচত। কিন্তু হয়েছে কী তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। ইউরোপে Structuralism
বলে একটি মতবাদ ১৯৬০-এর দশকে ছিলো। সেটি শব্দগুলোর অর্থ নির্দিষ্ট
করে দেয়। আমাদেরও সেরকম বিদেশি শব্দগুলার ক্ষেত্রে দেশি কোন শব্দটা ব্যবহার করা
হবে তা ঠিক করে দিয়ে প্রচারমাধ্যমে সেই শব্দগুলা চালু করলেই হবে। বাংলা পরিভাষার
জয় হোক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন