শনিবার, আগস্ট ২৪, ২০১৩

জনজীবনের রূপকার লালন





বস্তুবাদী লালন
লালন (১৭৭২- ১৭ অক্টোবর, ১৮৯০) হিন্দু কী যবন এ-প্রশ্ন অনেক গবেষকের কাছেই দীর্ঘদিনের প্রশ্ন। কিন্তু সাধারণ জনগণের কাছে লালন অতীতেও মানুষ ছিলেন বর্তমানেও মানুষ আছেন। লালনকে নিয়ে সমস্যা বাঁধিয়েছেই বিড়াল তপস্বী উচ্চ শিক্ষিত পণ্ডিতেরা আর সাম্প্রদায়িক উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা।

সাম্প্রদায়িক ভেদমুক্ত বস্তুবাদে সমৃদ্ধ লালনের গান বাংলার শ্রমিক - কৃষকের কাছে আজো জনপ্রিয়। লালনকে একজন বস্তুবাদীরূপে বিবেচনা করা কঠিননয়। লালন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বাইরে গিয়ে সারা জীবন জনগণের বস্তুবাদকে জীবনে অনুশীলন করেছেন।

জাতিভেদ বিরোধি ঐতিহ্যটি বাঙলায় এক মহান ধারা হিসেবে চিরদিনই টিকে ছিল। প্রাচীনকালে এ অঞ্চলে জাতিভেদ বিরোধী ছিলেন বৌদ্ধ, জৈন, বস্তুবাদী, চার্বাক, আজীবিক, আদিম জনজাতিগণ, লৌকিক তন্ত্রীরা। মধ্যযুগের তাবৎ ভক্তি আন্দোলন ধর্ম, লিঙ্গ, জাতিকে অগ্রাহ্য করেছে। বিশ শতকের পূর্বেই কর্তাভজা, সাহেবধনী, খুশী বিশ্বাসী, মতুয়া, সহজিয়া বৈষ্ণব প্রভৃতি লোকায়ত গোষ্ঠী জাতিভেদ বিরোধী আন্দোলন চালিয়েছেন। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলা বাউল গানে এসেছে,
“নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ।
সারা জাহান ভ্রমি দেখি একই মায়ের পুত।”  

এসবের ধারাবাহিকতায় লালন সাম্যবাদি সমাজের কথা, শ্রেণিহীন সমাজের কথা তাঁর গানে ফুটিয়ে তুলেছেন। নানা গানে নানা অভিব্যক্তিতে তিনি বলেছেন শ্রেণিভেদ ও জাতিভেদ বিলুপ্তির কথা। যেমন ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/ লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে’ কিংবা বলেছেন ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যে দিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান জাতি গোত্র নাহি রবে
এমন আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যায় যেগুলোতে তাঁর দর্শনের অনেক বস্তুবাদি উপাদান ছিলো

লালনের বস্তুবাদকে প্রাধান্য করে নিজের জীবনে সেসব অনুশীলন করেছিলেন। নিচে এরকম অনুশীলনের আটটি উদ্ধৃতি দেয়া হলো। গানের এসব উক্তি থেকেই আমরা বুঝতে পারবো লালন বস্তুর উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

১. মানুষের বীজে হয় না ঘোড়া
ঘোড়ার বীজে হয় না ভেড়া
যে বীজ সে গাছ জগতজোড়া
দেখরে তুই দুই নয়নে।

২. বস্তু বিনে নামে পেট কই ভরে।

৩. নৌকা ঠিক নাই বিনা পাড়ায়
নিরাকারে মন কি দাঁড়ায়।

৪. শরাতে সরপোষ লেখা যায়
বস্তু মারফত তাইতে ঢাকা রয়
সরপোষ নিই তুলে
কি দেই গো ফেলে
লালন বস্তুর ভিখারি।

৫. ভজ মানুষের চরণ দুটি
নিত্য বস্তু পাবে খাঁটি
লে হবে সকল মাটি
ত্বরায় লও সে ভেদ জেনে।

৬. নূর কী পানি বস্তু জানি লালন ফকির কয়।

৭. বস্তুকেই আত্মা বলা যায়
আত্মা কোনো অলৌকিক কিছু নয়।

৮. ক্ষিতি জল বাই হুতাসোন জে বস্তু যার শেইখানে মেশাইবে তা।
আকাশে মিশবে আকাশ জানা যায় এই পঞ্চ বেনা।

বাউল বিশ্লেষক শক্তিনাথ ঝা তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘বস্তুবাদী বাউল’ - এ দেখিয়েছেন যে বাউল সমাজের কেন্দ্রিয় বিশ্বাসের মর্মবাণী হলো, বর্তমান মানি, অনুমান মানি না। প্রত্যক্ষ মানি, অদেখা মানি না। বর্তমান তাদের কাছে প্রত্যক্ষ সত্য এবং অনুমান অসত্য। বাউল সমাজ ধর্ম ও চিন্তাকে দুভাবে ভাগ করে। প্রথমটি বর্তমানপন্থী এবং পরেরটি অনুমানপন্থী। বর্তমান বলতে অস্তিত্ববান সত্তা, যা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায়; অর্থাৎ যা  জীবিত, প্রত্যক্ষ ও বাস্তবিক তাকেই বোঝানো হয়েছে। আর অনুমান বলতে সূক্ষ্ম চিন্তা অথবা কাল্পনিক জিনিস যার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই অর্থাৎ যা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রমাণ হয় না বা প্রত্যক্ষ হয় না তাকে বোঝানো হয়েছে। এবং এই দুই রকমের অর্থেই শব্দ দুটি বাউল গানে ব্যবহৃত হয়েছে। লালন এই বর্তমান বা বাস্তব বস্তুবাদের অনুসারী। তিনি অদেখা ভাবুক দলে যাননি, প্রত্যক্ষ দর্শনের তিনি পথিক।

মাও সেতুং দ্বন্দ্ব সম্পর্কে নামক দার্শনিক প্রবন্ধে লিখেছেন মানুষের জ্ঞানের ইতিহাসে বিশ্ব বিকাশের নিয়ম সম্পর্কে চিরকালই দুটি ধারণা চলে এসেছে, আধিবিদ্যক ধারণা এবং দ্বন্দ্ববাদী ধারণা।মাও সেতুং-এর এই বাক্যটির চিরকালইশব্দটির প্রতি গুরুত্ব নির্দেশের জন্য জোর প্রদান করার ব্যাপারটিকে খেয়াল করলে বুঝবো যে সবকালেই কিছু মানুষ বস্তুবাদকে আঁকড়ে জীবন নির্বাহ করতেন। লালনের জীবনকালের সেই সময়ের প্রেক্ষিতে তাঁকে মুল্যায়ন না করলে যান্ত্রিক মূল্যায়ন হতে পারে। ২০১২ সালের বস্তুবাদ ও ১৮৬০ সালের বস্তুবাদচর্চার ভিতর ভিন্নতা থাকলেও লালন সেইসব যুক্তিই দিয়েছেন যা ভারতীয় প্রাচীন বস্তুবাদিরা দিয়ে গেছেন।

মার্কসবাদি না হলে কেউ প্রগতিশীল হতে পারে নাবিপ্লবী হতে পারে নাএটা খুবই দূর্বল চিন্তাকেউ বিপ্লবী কিনা সেটা নির্ধারণ হয় তার সমাজের সাপেক্ষেএবং তিনি তার সমাজকে পরবর্তি উন্নত সমাজে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন কিনা সেই দৃষ্টিকোণে।

তথ্যসূত্র ও টীকাঃ
১. এই নিবন্ধটি শক্তিনাথ ঝা’র মহাগ্রন্থ বস্তুবাদী বাউল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে দে’জ পাবলিশিং; কলকাতা।  
২. লালনের একটি পদে আছে ‘তবে কেন যাই অদেখা ভাবুক দলে’। 


আরো পড়ুনঃ

০১. মাও সেতুং কেন প্রাসঙ্গিক

০২. ভিয়েতনামের জাতিয়তাবাদি বিপ্লবী নেতা হো চি মিন

০৩. ফ্রানয মেহরিং জার্মানির সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিক ও নেতা

০৪. সাম্যের লেনিন, শ্রমিকের লেনিন, লেনিনময় পৃথিবী

 


বুধবার, আগস্ট ২১, ২০১৩

পাহাড়ি ফল রোসকোগুলো


রোসকোগুলো, ফটোঃ Jummo Adison
স্থানীয় চাকমা ভাষায় নাম রোসকোগুলো। ফলটি লতায় ধরে। কোনো গাছকে অবলম্বন করে লতাটি বেড়ে উঠে। পুরো লতাটির গায়ে থোকায় থোকায় এই ফল ধরতে দেখা যায়। ফলটি কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকে কিন্তু পাকলে লাল রঙ ধারণ করে। ফলটির ভেতরে বড় আকারের একটি বিচি থাকে। বাকল ফেলে দিয়ে বিচির গায়ে লেগে থাকা হালকা রস চুষে চুষে খেতে হয়। রস স্বাধে টক-মিষ্টি।

বুধবার, মে ০১, ২০১৩

শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব ও বাংলাদেশের লাশ হওয়া শ্রমিকগণ


নুপুর পায়ে নিহত বস্ত্রবালিকা

বাংলাদেশের শ্রমিকগণ আগুনে পুড়ে, অট্টালিকা ধ্বসে, দুর্ঘটনায়, পানিতে ডুবে, অপুষ্টিতে মারা যানকারখানা শ্রমিকদের এই নিয়তি পালটাতে হলে আমাদের সম্মুখে একটিই সমাধান রয়েছে এবং সেটি হলও শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব কায়েম করাকিন্তু সেটির ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে চিনের প্রাচিরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে বুর্জোয়াশ্রেণির একনায়কত্বগত ২৪ এপ্রিল, ২০১৩ বাংলাদেশের সাভারে ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যায় প্রায় ২০০০ শ্রমিককে হত্যা করা হয়
সপ্তাহখানেকের উদ্ধারে লাশ পাওয়া গেলো চারশআহত হলও ২৫০০বিদেশি প্রচারমাধ্যমগুলোতেও মৃতের ও নিখোঁজের সংখ্যা ১৫০০-এর বেশি বলা হয়েছেসারা দেশবাসি ক্ষুব্ধলাশ উদ্ধার তো হলই না লাশ গুম করা নিয়ে স্বজনেরা সর্বদাই তটস্থ থেকেছেনসারাদেশের শ্রমিক-কৃষক কেঁদে চলেছেন শেষ লাশটির জন্যঅথচ এই রাষ্ট্রযন্ত্র লাশের অধিকার পর্যন্ত ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছেএইরকম অবস্থায় শ্রমিক-কৃষকদের পক্ষে দাড়ানো যে কোনো শ্রমিকশ্রেণির দলগুলোসহ যে কোনো মানুষের পক্ষেই জরুরি ছিলোকিন্তু দেশবাসি দেখলো অন্য ব্যাপারঘটনার পরপরই বামমোর্চা, সিপিবি ও বাসদ গণহত্যাকারিদের শাস্তি ও শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে হরতাল ঘোষণা করেছিলেনকয়েক ঘণ্টা পরে বিএনপিও হরতাল ডেকেছিলো
আর মালিকদের চাপে জনশত্রুদের একাংশ লীগ হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছিলো এবং অন্য অংশ বিএনপি হরতাল প্রত্যাহার করেছিলোএরপর শ্রমিকশ্রেনির নামধারী সিপিবি নামক পেটি-বুর্জোয়াদের পার্টিটিও হরতাল থেকে সরে গিয়েছিলো১ মে, ২০১৩ বামমোর্চা এবং বাসদও হরতাল প্রত্যাহার করে নেয় অর্থা ২০০০ শ্রমিককে হত্যা করা হলেও বাংলাদেশে শ্রমিক শ্রেণির দলগুলো ন্যায্য দাবিতে হরতাল দিয়ে নিজেদের দৃঢ় মনোভাব বজায় রাখতে পারেন নাহে মহান শ্রমিকগণ, তোমাদের জন্য বাংলাদেশে এখন আর কে আছে?
অথচ গতকাল ৩০ এপ্রিল, ২০১৩তেও আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইলে শ্রমিকগণ রাস্তায় ছিলেন২৪ এপ্রিলের পরে সাভার, নারায়ণগঞ্জ, গাজিপুরে প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিকগণ সহিংস বিক্ষোভ করেছেন২৬ এপ্রিলে চট্টগ্রামে শ্রমিকগণ মিছিল থেকে গাড়ি ভাংচুর পর্যন্ত করেছিলেনএমনকি ঘটনার পরপরই শুরু হওয়া এই বিক্ষোভে সরকার ও মালিকরা ভীত হয়ে বিজিবি পর্যন্ত মোতায়েন করেছিলো
শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়ানো যেতে পারে কেবলমাত্র শ্রমিকদের রাষ্ট্র কায়েম করার মাধ্যমেই। কিন্তু এখনো যদি শ্রমিক শ্রেণির দলগুলো গত চল্লিশ বছরের লুটপাটে গড়ে ওঠা লোভী, পিশাচ, নিষ্ঠুর, নির্দয়, মুনাফাখোর, ব্যবসামনস্ক মধ্যবিত্তের দিকে তাকিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করে তবে শ্রমিকমুক্তি ঘটতে এদেশে বহু দেরি আছে।
দুই প্রধান রাজনৈতিক দল লিগ-বিএনপি তখনই বাংলাদেশ থেকে বাতিল হবে যখন কমিউনিস্টরা দির্ঘমেয়াদি কর্মসূচি দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব কায়েম করবেন। কিন্তু হয়তো আজ বাংলাদেশে সেই লক্ষণ আদৌ নেই, কিন্তু লক্ষণ দেখা দিতে কতক্ষণ। আমরা মনে করি বাংলাদেশের শ্রমিকের জন্য রয়েছে এই শ্রমিক বিপ্লবেই সমাধান এবং তারাই বিপ্লবের নিজস্ব শক্তি।
আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শিল্পশ্রমিক পেতে সবচেয়ে কম মজুরি দিতে হয়অর্থা সবচেয়ে সস্তা শ্রম এখন বাংলাদেশে সস্তায় শ্রম শোষণ করতে করতে সাম্রাজ্যবাদীরা বাংলাদেশকে শ্রমিকের জন্য অগ্নিকুণ্ড বানিয়েছেএমতাবস্থায়, আমরা শুধু বলতে পারি মুক্ত করো এই আগুন বর্বরতা থেকে হে মহান শ্রমিকগণ, কর্তৃত্ব গ্রহণ করো।

Featured Post

বাংলাদেশের পাখির তালিকা, A checklist of the birds of Bangladesh.

Oriental Magpie Robin; National Bird of Bangladesh বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর তালিকাটি অনেক সমৃদ্ধ। এদেশ পাখির দিক দিয়...